ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৮ই রমজান, ১৪৪৫ হিজরি, বিকাল ৫:০৩
বাংলা বাংলা English English

শুভ বাংলা নববর্ষ: প্রাসঙ্গিকতা


বাঙালি নানা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। আমাদের বাড়ির পাশে আরশি নগরে যে পড়শীরা বাস করে -হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, চাকমা, মগ, টিপরা, গারো, মনিপুরি,খাসিয়া-বহু মিশ্র প্রাণের সংসারে একাত্ম এ বাঙালি, বর্ষ বরণে বৃহৎ এ বাঙালি।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’ আজ বাংলা নববর্ষের মাহেন্দ্রক্ষণে তাই আমরা সমস্ত বাঙালি বৃহৎ, মহৎ।

জীবনের এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে উত্তরণের সঙ্গেই নববর্ষের উৎসব জড়িত। এই দিনে মনে হয় দেশ যেন কোনো এক দাগহীন কুমারীর মতো কারুময় ঘুম থেকে সদ্য জেগে ওঠা নারী। নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস দীর্ঘ কালের। ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে নববর্ষ পালিত হয়ে থাকে।

বর্ষবরণের ইতিহাসে প্রথম নববর্ষের খবর পাওয়া যায় মেসোপটেমিয়ায় ২০০০ খৃস্টপূর্বাব্দে। তখন কখনও মার্চ, সেপ্টেম্বর বা ডিসেম্বর থেকে নববর্ষ গণ্য করা হতো। ইংরেজি নববর্ষের ইতিহাস আলোচনা করলে জানা যায়, ৪৬ খৃস্টপূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজার যখন বাৎসরিক ক্যালেন্ডার পরিবর্তন করেন, তখন থেকেই জাঁকজমক এবং আনন্দ উল্লাসের সঙ্গে নববর্ষ পালিত হয়ে আসছে।

রাশিয়া, চীন, স্পেন প্রভৃতি দেশেও নববর্ষ পালিত হয়। সেই সঙ্গে কিছু কিছু প্রাচীন বিশ্বাসও উৎসবের অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। ইরানের নববর্ষ বা নওরোজ হলো সেইদিন – যেদিন সৃষ্টিকর্তা সোলেমান পয়গম্বরকে আংটি ফিরিয়ে দেন, পাখিরা তার উপর জলকণা বর্ষণ করতে থাকে। বলা বাহুল্য ইরানে পরবর্তীকালে ইসলামের প্রভাবে অনেক কিছুরই পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে ইরানে নওরোজ আরও ব্যাপক রূপ নিয়েছে। এই উপলক্ষ্যে তরুণরা তরুণীদের সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ সঙ্গিনী খুঁজে নিতে পারে। এমনই এক উৎসবেই মেহেরুন্নিছার (নুরজাহান) সঙ্গে সেলিমের (জাহাঙ্গীরের) চার চক্ষুর মিলন হয়। এই নববর্ষে শাজাহানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হতভাগিনী আনার কলির নাম।

ভৌগোলিক ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গেও নববর্ষের কিছুটা যোগ লক্ষ্য করা যায়। শীতপ্রধান দেশে সাধারণত নববর্ষ আসে জানুয়ারি মাসে। কিন্তু গ্রীষ্মপ্রধান দেশ বাংলার নববর্ষ বাংলা বছরের প্রথম মাস বৈশাখে। দু’দেশেই প্রকৃতিক বৈপরীত্যের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। অর্থাৎ শীতপ্রধান দেশে এই সময তুষারপাত, বরফপাত প্রভৃতি বিপর্যয় এবং গ্রীষ্মপ্রধান দেশে ঝড়-ঝঞ্ঝা, সাইক্লোনের মধ্য দিয়ে নববর্ষ আসে।

গ্রীষ্মপ্রধান দেশ বাংলাদেশ। প্রকৃতি তখন নিদারুণ দাবদাহে দগ্ধ হতে থাকে। কাজেই কৃষিজীবী সাধারণ মানুষের মনে ভয় ভীতি, উত্তপ্ত পৃথিবী নব জলধারায় স্নিগ্ধ হবে কিনা? ফসল ফলবে কিনা? বছরটি কেমন যাবে? কাজেই আনন্দ করতে হবে।

বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে নববর্ষ উৎসব ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করে বাংলার নব্য অভিজাত, উচ্চবিত্ত জমিদার ও মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ীদের পুণ্যাহ, হালখাতা প্রভৃতি উৎসবকে কেন্দ্র করে। মূলত এ উৎসবের অগ্রযাত্রা শুরু হয় বাংলার কৃষকের রক্ত শোষণের মধ্য দিয়ে। পুণ্যাহ উৎসবে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে অনেক কৃষককে সর্বস্বান্ত হয়ে জমিদারের সারা বছরের খাজনা আদায় করতে হতো। কিন্তু এতে জমিদারের উৎসবে কোনো ভাটা পড়েনি। জমিদারের বাগান বাড়িতে হালখাতার উৎসবে, পায়রা উড়ানো, ঘুড়ি উড়ানো, ঘোড়দৌড়, ষাড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই -এর মতো নানা উৎসবে অপব্যয়ের বন্যা বয়ে যেত। জমিদার ব্যবসায়ীদের এসব উৎসবের পাশাপাশি আঙ্গিনা সংলগ্ন স্থানে জনগণের চিত্ত বিনোদনের উদ্দেশ্যে যাত্রা, খেউর, টপ্পা, বাউল, কীর্তন, মারফতি, মুর্শিদি প্রভৃতি গানের আসর বসিয়ে দিত তারাই। এ সময় আসর চলত একদিন, দুইদিন, সাত দিন যাবত। এমনিভাবে এসব উৎসবকে ঘিরে গড়ে উঠত গ্রামীণ মেলা।

ড. নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, বাঙালির নববর্ষের উৎসব ছিল নবান্ন। তার কথায়, ‘বৈদিক যুগে বছরের প্রথম মাস হিসেবে ধার্য হয় অগ্রহায়ণ মাস। অগ্রাহায়ণ মাসের নবান্ন হতো।’ মুর্শিদকুলি খাঁ যখন বাংলার শাসক হন তখন খাজনা আদায়ের জন্য ধার্য হয় বৈশাখ মাস। অগ্রহায়ণ মাসকে পূর্বে বছরের প্রথম মাস হিসেবে ধরা হতো। কেননা ‘অগ্র শব্দের অর্থ আগে আর ‘হায়ণ’ শব্দের অর্থ সময় বা মাস। সুতরাং অগ্রহায়ণ বছরের প্রথম মাস।’

ড. আশরাফ সিদ্দিকী ‘হায়ণ’ ‘ধান’ অর্থে দেখিয়েছেন। ধান্য সম্ভারের প্রথম মাসকে অগ্রহায়ণ মাস ধরে গণনা করা হয়ে থাকবে। এরূপ গণনা বারোমাসিতেও পাওয়া যায়।

বাংলা নববর্ষের ইতিহাস আলোচনা করলে জানা যায়, সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৯) নির্দেশে এবং বিজ্ঞ রাজ জ্যোতিষী এবং পন্ডিত আমির ফতেহ সিরাজির গবেষণার ফলে বাংলা সনের উৎপত্তি ৯৯২ হিজরি =১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ। হিজরতের স্মৃতি রক্ষার্থে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) ৬২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে হিজরি সন প্রবর্তন করেন। এই সনের শুরু ১৬ জুলাই ৬২২ অব্দ ধরা হলেও আসলে হিজরতের তারিখ কিন্তু রবিউল মাসের ১২ তারিখ সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিস্টাব্দ।

আরব দেশের নিয়ম অনুযায়ী, বছরের প্রথম মাস পয়লা মহরম থেকে ধরা হয়েছে। হিজরি সন ছিল চান্দ্রমাস। চান্দ্রমাসের হিসেবে হিজরি সনেও তারিখের হেরফের হতো অর্থাৎ সৌর বৎসরের হিসেবে দিন তারিখ, মাসের গরমিল প্রচুর। মোটামুটি ৯৬৩ হিজরি = ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি মতান্তরে ১৪ এপ্রিল সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণ ও অভিষেকও পহেলা বৈশাখ, ৯৬৩ বাংলা সন। এ সন একদিকে যেমন নবী করিমের (সা.) হিজরত (৬২২) খ্রিস্টাব্দ তেমনি অন্যদিকে বাংলা সনের শুরু (৬২২) খ্রিস্টাব্দ এবং সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের (১৫৫৬) স্মৃতি বহন করে।

বাংলা সন ইংরেজি সনের থেকে ৫৯৩ বছর ৩ মাস ১১ দিন কম। অর্থাৎ মোটামুটি বাংলা সনের সঙ্গে ৫৯৩ যোগ দিলেই ইংরেজি সন মিলবে! সম্রাট আকবর অবশ্য তার রাজ্যকালের ২৯তম বর্ষে অর্থাৎ ১৫৮৪ সালে এ সাল চালু করেন। কাজেই সহজে অনুমেয় যে বাংলা সনের জন্ম হিজরি সনের জন্ম বছর ৬২২ এ। বাংলা সনের নবযাত্রা হিজরি ৯৬৩ = বাংলা সনও ৯৬৩। একটি কথা স্মরণযোগ্য যে প্রবর্তিত বাংলা সন ও প্রচলিত হিজরি সনের নব পর্যায়ের শুরু এক হলেও চন্দ্র মাসের হেরফেরে হিজরি সন এগিয়ে গেছে ১০ দিন এবং বাংলা সন ১০ দিন পিছিয়ে গেছে।

পুরাণ অনুসারে দক্ষ প্রজাপতির সাতাশটি সুন্দরী কন্যা, যথা -অশ্বিনী, ভরণী, মৃত্তিকা, রোহিনী, মৃগশিরা, আদ্রা, পুর্নবসু, পুষ্যা, অশ্লেষা, মঘা, পূর্বফাল্গুনী, উত্তর ফাল্গুনী, হস্তা, চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, অনুরাধা, জৈষ্ঠা, মূলা, পূর্বাষাঢ়া উত্তরাষাঢ়া শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, শতভিসা, পূর্বভাদ্রপদা, উত্তরভাদ্রপদা ও রেবতী। এই সাতাস কন্যার বিয়ে হয় একমাত্র উপযুক্ত পাত্র চন্দ্রদেবের সঙ্গে। চন্দ্রদেবকে প্রতিমাসে প্রতিস্ত্রীর সঙ্গে দর্শন দিতে হবে। এতে করে তার সময়, লাগবে ২৭ দিন। শেষে তিন দিন বিশ্রাম। অন্যদিকে চাঁদ যে নক্ষত্রে এসে পূর্ণিমা ঘটায় তা থেকে সে মাসের নাম হবে।
যেমন- বিশাখা >বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠা >জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া >আষাঢ় ইত্যাদি।

ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে ১৯৬৮ সনে বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে প্রচলিত বাংলা সন নিম্নোক্তভাবে সংস্কার করা হয়-

বৈশাখ — ভাদ্র = ৩১ দ্ধ ৫ = ১৫৫ দিন
আশ্বিন — ফাল্গুন = ৩০ দ্ধ ৬ = ১৮০ দিন
চৈত্র = ৩০ দ্ধ ১ = ৩০ দিন
————————————————————-
৩৬৫ দিন
অধিবর্ষ = ১ দিন
————————————-
৩৬৬ দিন

এটি এখনও সরকারিভাবে পূর্ণ চালু করা সম্ভব হয়নি।

বৈশাখ মাসকে নববর্ষের প্রথম মাস হিসেবে বাঙালি সমাজে বরণ করে নেবার রীতি খুব বেশি দিনের নয় বলে মনে হয়। কেন না ঋতু পরিক্রমায় গ্রীষ্মের প্রথম মাস বৈশাখ জনজীবনের কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণের বার্তাই বয়ে আনে বেশি। খনার বচনে এ কারণে অন্যান্য মাসের তুলনায় বৈশাখ মাসের পরিচয় অপেক্ষাকৃত কম। খনা বৈশাখ সম্পর্কে যেটুকু পরিচয় তুলে ধরেছেন – তাতে বৈশাখের বিরূপ চিত্রই অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে। যেমন –

ক. পৌষে গরমি বৈশাখে ঝাড়া
পয়লা আষাঢে় ভরবে গাড়া।
খ. চৈত্রে খর খর
বৈশাখেতে ঝড় পাথর।

বৈশাখের রুদ্রমূর্তি দর্শনে ভীত বিহ্বল জন চিত্তকে দুর্বার শক্তিতে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে আহ্বান করেছেন রবীন্দ্রনাথ-

ওই বুঝি কালবৈশাখী
সন্ধ্যা আকাশ দেয় ঢাকি।
ভয় কিরে তোর ভয় কারে, দ্বার খুলে দিস চারধারে
শোন দেখি ঘোর হুঙ্কারে, নাম তোর ওই যায় ডাকি
পরিশেষে বৈশাখ বন্দনায় কবিগুরুর কথা দিয়েই শেষ করছি-

জাগো ফুলে ফলে নব তৃণ দলে
তাপস লোচন মেলো হে।
জাগো মানবের আশায় ভাষায়,
নাচের চরণ ফেলো হে।

লেখক: নারগীস পারভীন, প্রভাষক, কবি কাজী নজরুল ইসলাম কলেজ, রাজশাহী।

 

সব খবর