ঢাকা, শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৯শে রমজান, ১৪৪৫ হিজরি, ভোর ৫:১৯
বাংলা বাংলা English English

ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয় কেন, কারা করেন?


একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলে একই সময়ে একাধিক ঘূর্ণিঝড় হতে পারে এবং তা এক সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় টিকে থাকতে পারে। তাই বিভ্রান্তি এড়াতে, ঘূর্ণিঝড় বিষয়ক সচেতনতা ছড়াতে এবং ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা ও প্রশমনের জন্য প্রতিটি ক্রান্তীয় ঝড়েরই একটি করে নাম দেওয়া হয়।

আবহাওয়াবিদরা ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়া মাত্রই ঘূর্ণিঝড়ের একটা চমৎকার, অদ্বিতীয় ও অকৃত্রিম নাম পেয়ে যাই আমরা। অনেকেরই মনে তখন প্রশ্ন জাগে, এই অদ্ভুত নামকরণের কারণ কি? কাদের হাত আছে এর পেছনে?

রোববার (৮ মে) সকালে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’র কথা জানার পরেও পাঠকের মনে নিশ্চয়ই একই প্রশ্ন উদয় হয়েছে। ‘অশনি’ নামকরণটি করেছে শ্রীলঙ্কা, সিংহলী ভাষায় এর অর্থ ‘ক্রোধ’। এই মুহূর্তে ঘূর্ণিঝড়টি পূর্ব উপকূলে, ভারতের উড়িষ্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

বর্তমানে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার আঞ্চলিক কমিটি একেকটি ঝড়ের নামকরণ করে। এক সময় ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়া হত না। আগে বিশ্বের অন্য অঞ্চলের ঝড়ের নাম দেওয়া না হলেও যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলে ঝড়ের নামকরণ করা হতো।

 

কেন নামকরণ?

এক সময় ঝড়গুলোকে বিভিন্ন নম্বর দিয়ে শনাক্ত করা হতো। কিন্তু সেসব নম্বর সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য। ফলে সেগুলোর পূর্বাভাস দেওয়া, মানুষ বা নৌযানগুলোকে সতর্ক করাও কঠিন মনে হতো।

নামবিহীন থাকলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি, ধরন সম্পর্কে তথ্য দ্রুত জানা যায় না। এর আঘাত হানার সময় বা তারিখ বের করে পরবর্তী সময়ে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করতে হয় আবহাওয়াবিদদের। এটি বেশ সময়সাপেক্ষ।

যেভাবে নামকরণ করা হতো

গত কয়েক শতাব্দী ধরে আটলান্টিক ঝড়ের নাম দেওয়া হয়ে আসছে যেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বলবৎ থাকে। এরপরে আবহাওয়াবিদরা মিলে মেয়েদের নামে ঝড়গুলোর নামকরণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৫৩ সালে US Weather Service আনুষ্ঠানিকভাবে Q, U, X, Y, Z ব্যতীত A থেকে W পর্যন্ত আদ্যক্ষরে মেয়েদের নামে ঝড়ের নামকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এ নিয়ে ৬০ এবং ৭০ এর দশকে নারীদের প্রতিবাদের মুখে অবশেষে ১৯৭৮ সালে ছেলেদের নামেও ঝড়ের নামকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বছরের প্রথম ঝড়ের নাম রাখা হত A আদ্যক্ষর দিয়ে, দ্বিতীয় ঝড়ের নাম রাখা হত B আদ্যক্ষর দিয়ে, এভাবে চলতে থাকতো। আবার জোড় সালের বিজোড় ঝড়গুলোর (মনে করি ২০১৪ সালের ৩য় ঝড়) নাম রাখা হত ছেলেদের নামে আর বিজোড় সালের বিজোড় ঝড়গুলোর নাম রাখা হত মেয়েদের নামে।

এক বছরে ২১ টির বেশি হারিকেন উৎপন্ন হলে (২০০৫ সালে যেমন হয়েছিল), গ্রিক বর্ণমালা অনুযায়ী নামকরণ করা হয়- হারিকেন আলফা, বিটা ইত্যাদি।

নাম কিভাবে ঠিক করা হয়?

এখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শত শত কেন্দ্র, উপকূলীয় ঘাটি ও সমুদ্রে অবস্থিত জাহাজগুলোতে ঝড়ের তথ্য পাঠানোর জন্য যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত ও সহজে উচ্চারণযোগ্য নাম ঠিক করা হয়। পুরনো জটিল পদ্ধতিতে অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ দিয়ে নির্ণয়ের চাইতে এই প্রক্রিয়া অনেক বেশি সহজ এবং এতে ভুল কম হয়। ১৯৫৩ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হ্যারিকেন সেন্টারের তৈরিকৃত তালিকা থেকে আটলান্টিক ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণ করা হয়।

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে ঘূর্ণিঝড়ের নারীসুলভ নাম দেওয়া শুরু হয়। তবে এ প্রক্রিয়াকে আরও সুসংগঠিত ও কার্যকরী করে তোলার জন্য আবহাওয়াবিদরা একটি তালিকা থেকে নাম বাছাই করার সিদ্ধান্ত নেন বলে ডব্লিউএমও’র ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়।

নামকরণের ক্ষেত্রে দেশগুলোকে যে বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হয়, তা হলো- নামটি যেন লিঙ্গ নিরপেক্ষ হয় এবং কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়। এছাড়াও, নামটি হবে সর্বোচ্চ আট অক্ষরের। কোনো সদস্য দেশের অনুভূতিতে আঘাত করে বা তাদের প্রতি অপমানসূচক কোনো নামও রাখা যাবে না। যদিও প্যানেলের হাতে ক্ষমতা থাকে প্রস্তাবিত কোনো নাম প্রত্যাখ্যান করে দেওয়ার, তবুও চূড়ান্ত নামকরণের পরে কোনো সদস্য দেশ আপত্তি জানালে তা পুনঃমূল্যায়নের প্রয়োজন হতে পারে। আর একবার যে নাম ব্যবহার করা হয়, তার আর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না কখনো।

পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়ের নামও তৈরি!

ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাব এখনো চলমান, এরইমধ্যে পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়ের নামও ঠিক করা হয়ে গেছে! অশনির পরের ঘূর্ণিঝড়ের নাম হবে ‘সিত্রাং’ এবং এই নামটি দিয়েছে থাইল্যান্ড।

২০২০ সালে ১৩টি দেশ থেকে ১৩টি নামসহ মোট ১৬৯টি নাম সম্বলিত তালিকা প্রকাশ করা হয়। এর আগে ৮টি দেশ ৬৪টি নাম দিয়েছিল। ভারত থেকে দেওয়া নামসমূহের মধ্যে রয়েছে মেঘ, গতি, আকাশ; বাংলাদেশ থেকে দেওয়া অগ্নি, হেলেন ও ফণি এর আগে ব্যবহৃত হয়েছে এবং পাকিস্তান দিয়েছিল লায়লা, নারগিস ও বুলবুল। ভবিষ্যতে যেসব নাম ব্যবহৃত হবে, তার মধ্যে আছে ঘূর্ণি, প্রবাহ, ঝড় মুরাসু (ভারত থেকে); বিপর্যয় (বাংলাদেশ), আসিফ (সৌদি আরব), দিকসাম (ইয়েমেন), তুফান (ইরান) এবং শক্তি (শ্রীলঙ্কা)।

ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ কারা করেন?

ঘূর্ণিঝড়ের নাম জানার পর মনে হতেই পারে, আসলে একটা ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করার প্রয়োজন কী? কারাই বা এসব নামকরণ করেন?

জাতিসংঘের অধীনস্থ, বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) তথ্যানুযায়ী, একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলে একই সময়ে একাধিক ঘূর্ণিঝড় হতে পারে এবং তা এক সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় টিকে থাকতে পারে। তাই বিভ্রান্তি এড়াতে, ঘূর্ণিঝড় বিষয়ক সচেতনতা ছড়াতে এবং ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা ও প্রশমনের জন্য প্রতিটি ক্রান্তীয় ঝড়েরই একটি করে নাম দেওয়া হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন সমুদ্র অববাহিকায় সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আঞ্চলিক বিশেষায়িত আবহাওয়া দফতর (আরএসএমসি) এবং ট্রপিক্যাল সাইক্লোন ওয়ার্নিং সিস্টেমস (টিসিডব্লিউএস)- এর উপর। বিশ্বজুড়ে ৬টি আরএসএমসি এবং ৫টি টিসিডব্লিউএস রয়েছে।

ভারত মহাসাগরের উত্তরভাগে এবং এর সঙ্গে লাগোয়া বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণের ক্ষেত্রে একটি মানসম্মত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ভারতের আবহাওয়া দফতর (আইএমডি) এবং নয়াদিল্লীতে অবস্থিত আরএসএমসি। ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়গুলো নিজস্ব নাম পেতে শুরু করে ২০০০ সালের পর থেকে। সে বছর ওমানের মাসকটে ডব্লিউএমও’র ২৭তম অধিবেশনে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেখানে অংশগ্রহণকারী ৮টি দেশ- ভারত, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড ২০০৪ সাল থেকে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ শুরু করে।

উত্তর ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬২ কিলোমিটার হয়ে গেলে সেই ঘূর্ণিঝড়ের একটি নাম দেয় আইএমডি।

সূত্র: দ্য ফেডারেল

সব খবর