প্রেসিডেন্টের পদ থেকে গোতাবায়া রাজাপাকসেকে সরিয়ে দিতে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে শ্রীলঙ্কানরা। বুধবারে (১১ মে) জাতির উদ্দেশে দেয়া তার ভাষণও সমালোচনার মুখে পড়েছে ব্যাপকভাবে।
কিন্তু এসব কিছুকে পাত্তা না দিয়ে নিজের সিদ্ধান্তে অটল তিনি। আপাতত ক্ষমতা ছাড়ার কোনো লক্ষণ তার মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। আর জনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অঙ্গীকার করেছেন তিনি।
গত মাসে বিক্ষোভ শুরু হবার পর এই প্রথম ভাষণ দেন গোতাবায়া রাজাপাকসে। এ সময়ে প্রেসিডেন্টের কিছু ক্ষমতা পার্লামেন্টকে দেয়ার প্রস্তাব দেন তিনি। তবে কবে তা তুলে দেবেন; সেই সময়সীমার কথা উল্লেখ করেননি। তার প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরিতেও জনগণের ক্ষোভ কমেনি। খবর বিবিসির।
ভারত মহাসাগরীয় দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকট চলছে। মানুষের স্বাভাবিক জীবনে স্থবিরতা নেমে এসেছে। শ্রীলঙ্কার নাগরিকরা বলছেন, তার (গোতাবায়া) বক্তব্যে বাস্তব সংকটগুলো পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি সত্যিকারের কোনো সুরাহা দিতে পারেননি।
কাভিন্দিয়া থেনাকুন নামের কলোম্বোর এক বিক্ষোভকারী অভিযোগ করেন, গেল ত্রিশটি দিন আপনি (গোতাবায়া রাজাপাকসে) কোথায় ছিলেন? ওষুধের ঘাটতির কারণে মানুষ সঠিকভাবে চিকিৎসা নিতে পারছে না। তাদের কাছে খাবার নেই, পুরো দেশ স্থবির হয়ে পড়েছে। অথচ আপনার কোনো খোঁজ ছিল না।
তিনি আরও বলেন, গোতাবায়া যে সংস্কারের পরামর্শ দিলেন, তার সঙ্গে আমাদের চাওয়া-পাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের এখন সবচেয়ে বেশি দরকার প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ। কিন্তু গোতাবায়া তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
চলতি সপ্তাহের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবিতে সরব ছিল সামাজিকমাধ্যম ব্যবহাকারীরা। তিনি সরে গেলে এবার তার ভাই ও প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পালা। মানুষ তার পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে, সামাজিকমাধ্যমেও সরব নেটিজেনরা।
বৃহস্পতিবার সকালে এক বিক্ষোভকারী টুইটারপোস্টে বলেন, ‘একজনের পতন ঘটেছে, এবার অন্যদের পালা।’ আরেকজন বলেন, আপনার (গোতাবায়া) ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে ও মন্ত্রীদের পরামর্শ দেন, তারা যাতে তাদের পালিত গুণ্ডাদের নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি যাতে তাদের সন্ত্রাসের রাজত্বে লাগাম টেনে ধরেন। তাদের নির্বুদ্ধিতার কারণেই দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে।
সোমবার লঙ্কান প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন টেম্পল ট্রিতে বৈঠক শেষে মাহিন্দা রাজাপাকসের সমর্থকরা কলোম্বোতে বিরোধীদের ওপর হামলা চালায়। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে চেপে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। তারা রাজাপাকসে পরিবারের বিভিন্ন স্থাপনা ও সরকারি সম্পত্তিতে হামলা ও ভাঙচুর শুরু করে।
দেখামাত্রই গুলি করার নির্দেশ
সোম ও মঙ্গলবার রাতে শ্রীলঙ্কায় ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার পরও আন্দোলনকারীরা ঘরে ফেরেনি। বাণিজ্যিক রাজধানী কলোম্বোর বিভিন্ন দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এমনকি মাহিন্দা রাজপাকসার ছেলের মালিকানাধীন রিসোর্টেও আগুন দেয়া হয়। তার বাবাকে উৎসর্গ করে গড়ে তোলা একটি জাদুঘরও ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা ছিলেন দুবারের প্রেসিডেন্ট, দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের একজন। বর্তমানে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উত্তর-পূর্বের একটি নৌঘাঁটিতে গা-ঢাকা দিয়েছেন। ছেলে ও ১৫ সহযোগীসহ তার বিরুদ্ধে দেশ ছাড়ার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন একটি আদালত।
শ্রীলঙ্কাজুড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। কলোম্বোর সড়কে তাদের টহল দিতে দেখা যাচ্ছে। যারাই সরকারি সম্পত্তি কিংবা রাজাপাকসে পরিবারের স্থাপনায় হামলা চালাবে তাদের দেখামাত্রই গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
কিন্তু বুধবার দেয়া ভাষণে মাহিন্দা রাজপাকসের সমর্থকদের তাণ্ডব নিয়ে নীরব ছিলেন গোতাবায়া। বরং বিক্ষোভকারীদের সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে তাদের বিরুদ্ধে পূর্ণোদ্যমে পদক্ষেপ নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দেন তিনি।
বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে ইতিমধ্যে দেশজুড়ে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। এতে ব্যবসা, সরকারি অফিস ও দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়। বৃহস্পতিবার সকালে সান্ধ্য আইন উঠিয়ে নেয়ার পর আবার তা পুনর্বহাল করা হয়েছে।
কলোম্বো থেকে বিবিসির সাংবাদিক আনবারাসান ইথিরাজান বলেন, ফিলিং স্টেশনের সামনে লোকজন সারিবদ্ধ হয়ে অপেক্ষা করছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করতে লোকজন বাইরে বের হয়েছেন। যদিও তা তাদের নাগালের বাইরে। জীবনের প্রয়োজনে লোকজন রাস্তায় নেমে এসেছেন।
মানুষের এত ক্ষোভ কেন?
দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে খাদ্য ও জ্বালানি ফুরিয়ে গেছে। এছাড়া বাজারে যা পাওয়া যাচ্ছে, তা-ও অধিকাংশের ক্রয়ক্ষমতার আওতায় নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য লঙ্কানরা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। তাদের জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়েছে।
শ্রীলঙ্কার মুদ্রা রুপির মান পড়ে গেছে। অর্থনৈতিক সংকট এমন তলানিতে চলে গেছে, যা দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর আর কখনো দেখা যায়নি। যদিও এ বিপর্যয়ের জন্য করোনা মহামারিকে দায়ী করতে চাচ্ছে দেশটির সরকার।
অতিসংক্রামক ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাবে ভারত মহাসাগরীয় দেশটির পর্যটননির্ভর অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। অথচ পর্যটন শিল্প দিয়েই তাদের বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার আয় হতো। কিন্তু গত কয়েক বছরে তাতে ধস নেমেছে।
বছর তিনেক আগে গির্জায় কয়েক দফায় প্রাণঘাতী বোমা হামলার পর পর্যটকদের মধ্যে ভীতি ঢুকে গেছে। তারা দেশটিতে ভ্রমণে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। যার প্রভাব পড়েছে লঙ্কান অর্থনীতিতে।
এতে ক্ষমতাসীন রাজপাকসে পরিবারের ওপর মানুষের ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। লোকজন মনে করেন, দেশের অর্থ লুটপাট করতে স্বজনদের সুযোগ করে দিয়েছেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। এর মাধ্যমে তিনি নিজেও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছেন।
প্রেসিডেন্টের সব ভাই ও কয়েকজন ভাতিজা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। পরে বিক্ষোভের কারণে তাদের পদত্যাগ করতে হয়েছে। ক্ষোভ থেকে বাঁচতে কয়েকজন ইতিমধ্যে দেশ ছেড়েও পালিয়েছেন।
রাজনৈতিক বিকল্প কী?
ইতিমধ্যে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন রনিল বিক্রমাসিংহে। এরআগেও তিনি দেশটিতে পাঁচবার প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করেন। এখন তিনি একটি নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করবেন। পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠদের নেতৃত্ব দেবেন। গেল কয়েক দশক ধরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে তার সরব উপস্থিতি রয়েছে।
এবার রাজাপাকসে পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে তাকে। তারা যাতে নিরাপদ থাকতে পারেন, সেই পথও বের করার দায়িত্ব তার ওপর বর্তাবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ কিংবা পার্লামেন্টে বিরোধীদের সার্বিক সমর্থন তিনি পাবেন না।
একটি ঐক্য সরকার গঠনে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে বসার কথা জানিয়েছিলেন গোতাবায়া রাজাপাকসে। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বলছে, প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ না করলে কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে তারা অংশ নেবেন না।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে একটি সহায়তা প্যাকেজ ছাড় করার চেষ্টা করছে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু অস্থিতিশীলতার বিড়ম্বনায় তা কঠিন হয়ে পড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। দ্বীপটির আট হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনীতি বর্তমানে দেউলিয়া হওয়ার পথে।
ইতিমধ্যে বিদেশি ঋণ পরিশোধ স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছে লঙ্কান সরকার। তাদের বৈদেশিক মুদ্রার আয় একেবারে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৯ সালে জনতুষ্টিমূলক করহার হ্রাস ও ২০২১ সালে রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ করার পর সংকট তীব্র রূপ নিয়েছে। কারণ এতে ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে গেছে।