ঢাকা, শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৯শে রমজান, ১৪৪৫ হিজরি, রাত ২:৪০
বাংলা বাংলা English English

শেখ কামালের আদর্শ ও উদ্যোগ নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে


“{ মোঃ ইলিয়াছ মোল্লা}” 

বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শহীদ শেখ কামাল সংগীত, নাটক, ক্রীড়া ও সামাজিক কর্মে তরুণদের নেতৃত্ব দেওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা নতুন প্রজন্মের কাছে কাছে তুলে ধরতে হবে । শেখ কামাল ছিলেন বাংলাদেশের আধুনিক ক্রীড়া ও সংস্কৃতি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ । শহীদ শেখ কামালকে অনুসরণ করে যেন আলোর পথের দেখা পায় নতুন প্রজন্ম । মহান মুক্তিযুদ্ধ, ছাত্ররাজনীতি, সাংস্কৃতিক কর্মকাÐ, খেলার মাঠ থেকে নাটকের মঞ্চ-সর্বত্র ছিল তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। শেখ কামালের অকালমৃত্যুতে দেশের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র তো বটেই, রাজনীতিতেও এক অসামান্য ও অপ‚রণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে । একজন সৃজনশীল উদ্যমী প্রাণবন্ত তরুণ, যিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র ধরেছেন, সংগীত, নাটক, ক্রীড়া ও সামাজিক কর্মে তরুণদের নেতৃত্ব দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন তা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা অতিব জরুরী ।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ২য় সন্তান শহিদ শেখ কামাল । ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট বাঙালির পীঠস্থান শাশ্বত সুনিবিড়, সবুজ-শ্যামল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। শহিদ শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ১৯৬৯ সালে ভর্তি হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৪ সালে স্নাতক (সম্মান) পাশ করেন। তিনি স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু দুর্ভাগ্য তিনি তার ফলাফল দেখে যেতে পারেননি। ১৯৭৬ সালের ২৯ জানুয়ারিতে স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয় যাতে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণী পেয়ে উত্তীর্ণ হন । এর আগে ঢাকার বিএএফ শাহীন স্কুল থেকে ১৯৬৭ সালে এসএসসি (মাধ্যমিক) পাশ করেন ও ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। স্কুল জীবন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিনয়ী ও মার্জিত শেখ কামাল তার মানবিক গুণাবলী ও সাংগঠনিক  কর্মকান্ডের জন্য বন্ধু, সহপাঠী সকলের কাছেই সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। ছাত্রলীগের একজন সক্রিয়, আদর্শবাদী একনিষ্ঠ কর্মী ও দক্ষ সংগঠক হিসেবে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা, ১১ দফা আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে শহিদ শেখ কামাল সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন এবং আশেপাশের সবাইকে উদ্দীপ্ত করেছেন। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ছিলেন। তিনি ছাত্রলীগের বিভাজন দ‚র করে সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করতে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য ছিলেন । মহান মুক্তিযুদ্ধে শেখ কামালের অবদান ছিল বীরোচিত। মাত্র ২২ বছর বয়সে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ও তখনকার ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করতে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেন। ২৫শে মার্চ কাল রাতে পাকহানাদার বাহিনী ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কস্থ বাসভবন আক্রমণ করার প‚র্ব মুহ‚র্তে বাড়ি থেকে বের হয়ে তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

তিনি পাকহানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের চোখ এড়িয়ে গোপালগঞ্জ হয়ে ইছামতী নদী পাড়ি দিয়ে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত পার হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পৌঁছান। [তথ্য স‚ত্র: বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী, এবিএম সরওয়ার-ই-আলম সরকার] । বঙ্গবন্ধুর মেজো ছেলে শহিদ শেখ জামালও মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট সকালে কাউকে না জানিয়ে তারকাটার বেড়া দেওয়া পাক বাহিনীর ধানমন্ডির বন্দীশিবির থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তৎকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিবাহিনী গঠন করে। মুক্তিবাহিনীর সুদক্ষ নেতৃত্ব তৈরির জন্য জেন্টলম্যান ক্যাডেট নির্বাচন করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরের মধ্য থেকে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ৬১ জনকে নির্বাচিত করা হয়। শহিদ শেখ কামাল ছিলেন এই ৬১ জনের মধ্যে একজন। এই ‘ফার্স্ট বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের’ ক্যাডেট দের আধুনিক অস্ত্র প্রশিক্ষণ, গেরিলা যুদ্ধে দুর্র্ধষ চৌকস করে তোলা হয় ১৪ সপ্তাহের কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। এই ওয়ার কোর্সের কঠিন প্রশিক্ষণ শেষে শেখ কামাল মুক্তিবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন এবং একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি (এইড-দ্য-ক্যাম্প) হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি এডিসি হিসাবে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সংগঠিত করেছেন। গেরিলা বাহিনীর সংগঠনে ও তাদের প্রশিক্ষণে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। বঙ্গমাতা ও ভাইবোনদের সকল উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দ‚র করে ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা দু’ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামাল।

মুক্তিযুদ্ধের পর সামরিক বাহিনীতে না থেকে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যান এবং লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। স্বাধীনতার পর দেশ ছিল বিপর্যস্ত । নবগঠিত রাষ্ট্র বাংলাদেশে ফিরেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে দেশ পুনর্গঠনের কাজে সম্প‚র্ণর‚পে আত্মনিয়োগ করেন শেখ কামাল। শেখ কামাল শুধু একজন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও তরুণ রাজনীতিবিদই ছিলেন না, ছিলেন একজন অপাদমস্তক ক্রীড়াপ্রেমী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক। স্কুল জীবন থেকেই তিনি ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, হকি, বাস্কেটবলসহ বিভিন্ন খেলার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। স্কুলে একজন ফাস্ট বোলার হিসেবে তার সুনাম ছিল। তিনি দীর্ঘদিন আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট খেলেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বাস্কেটবল টিমের অধিনায়ক ছিলেন। একজন ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে তিনি যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা আজও সবাই অকপটে স্বীকার করে। বাংলাদেশের খেলাধুলাকে বিশ্বমানের করার স্বপ্ন ছিল তার চোখে। তার হাত ধরেই বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে বিপ্লব সংঘটিত হয়। ১৯৭২ সালে ঐতিহ্যবাহী আবাহনী ক্রীড়াচক্র প্রতিষ্ঠা করেন শেখ কামাল। শুধু শেখ কামাল নন, তার স্ত্রী সুলতানা কামালও বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে গুরুত্বপ‚র্ণ ভ‚মিকা রেখেছেন। সুলতানা কামাল খুকী ছিলেন বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের হয়ে লং জাম্প ও ১০০ মিটার স্প্রিন্টে রুপা ও ব্রোঞ্জ পদক জয়ী প্রথম অ্যাথলেট। তিনি ছিলেন স্প্রিন্ট আর লং জাম্পে ন্যাশনাল রেকর্ডধারী। সুলতানা কামালের নামটাও স্মরণীয় হয়ে আছে বর্তমান প্রজন্মের অ্যাথলেটদের কাছে। দেশের ক্রীড়াঙ্গন চিরকাল ঋণী থাকবে শেখ কামাল ও সুলতানা কামালের কাছে, কারণ তাদের হাত ধরেই নতুন ধারার স‚চনা হয় এদেশের ক্রীড়াঙ্গনের।

খেলাধুলার পাশাপাশি শেখ কামাল সংগীত, নাটক, বিতর্কসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাÐে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। শেখ কামাল অভিনয়শিল্পী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনে পরিচিত মুখ ছিলেন। তিনি ছায়ানটে সেতার বাজানো শিখতেন এবং খুব ভালো সেতার বাজাতেন। তিনি সেতার বাজানো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তৎকালীন প‚র্ব পাকিস্তানে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। ‘নাট্যচক্র’, ‘ঢাকা থিয়েটার’ ও ‘স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী’ সহ আরও অনেক সংগঠন তিনি গড়ে তুলেছিলেন। শেখ কামাল ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই ক্রীড়াবিদ সুলতানা কামাল খুকীকে বিয়ে করেন। শেখ কামালের বিয়ের মাত্র ১ মাসের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় বাঙালির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাড়িতে থাকা পরিবারের সবাইকে। ১৫ আগস্ট নৃশংস এই হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ আবু নাসের, বঙ্গবন্ধুর পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধ‚ সুলতানা কামাল ও পারভীন জামাল রোজী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি ও তার স্ত্রী বেগম আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নীপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, শিশুপুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু ও বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ। দেশের বাইরে থাকায় সেদিন প্রাণে বেঁচে যান জাতির পিতার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। শহিদ শেখ কামালের (মহান মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে) বিভিন্ন অবদান ইতিহাস থেকে আড়াল করার জন্য তার বিরুদ্ধে নানা রকম অপপ্রচার, মিথ্যাচার চালিয়েছিল ঘাতক ও বাংলাদেশ বিরোধী চক্র। মাত্র ২৬ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে শেখ কামাল রাজনীতি, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে অবদান রেখে গেছেন, তা চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। তার মতো দক্ষ এক সংগঠক আজ বেঁচে থাকলে এ দেশের ক্রীড়াঙ্গন, সংস্কৃতি অঙ্গন, রাজনীতিতে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন আসত। ক্ষণজন্মা কিংবদন্তীতুল্য নেতার আজ জন্মদিন। ৭২তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানাই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব শহিদ শেখ কামালের প্রতি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাছে একটাই দাবি করব— যেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল যে সব অবদান রেখে গেছেন মুক্তিযুদ্ধে, রাজনীতি, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, সেগুলোর সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

লেখক , মোঃ ইলিয়াছ মোল্লা , বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

সব খবর